বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৪ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: দেনমোহর জামানতবিহীন দেনা। একজন বিধবা তার স্বামীর পরিশোধ করে না যাওয়া দেনমোহর পাওয়ার অধিকারিণী। স্বামীর মৃত্যু হলেই যে দেনমোহর পাবেন না, তা নয়। দেনমোহর ঋণের মতো, স্বামীর অবর্তমানে স্বামীর উত্তরাধিকারীরা তা পরিশোধ করতে বাধ্য। এছাড়া বিধবা স্ত্রী মৃত স্বামীর অন্যান্য পাওনাদারদের মতো ত্যক্ত সম্পত্তি হতে দেনমোহরের পাওনা আদায় করার অধিকারিণী।
মুসলিম আইন অনুযায়ী, একজন বিধবা মা তার মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে অংশ পাবেন। একজন বিধবা মাকে তার মৃত স্বামীর সম্পত্তির ১/৮ অংশ দিতে হবে। বিধবা মায়ের অধিকার রয়েছে তার স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অংশ স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার। একজন বিধবা মায়ের ভরণপোষণের ব্যাপারে কারও ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ না করা হলেও তা অবধারিতভাবেই সন্তানদের ওপর বর্তায়। বাবার মৃত্যু হলে এবং বাবা যদি আপনার মাকে দেনমোহর না দিয়ে থাকেন, তাহলে বিধবা মা বিলম্বিত দেনমোহর সন্তানদের কাছ থেকে দাবি করতে পারবেন।
দেনমোহর পরিশোধ না করা হলে স্বামীর মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা করে তিনি তা আদায় করতে পারবেন। এছাড়া স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অংশ একজন বিধবা স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারবেন কিংবা দখলে রাখার অধিকার রয়েছে বলে বিবি বাচান বনাম শেখ হামিদ (১৮৭১) ১৪ এম.আই.এ. পৃষ্ঠা ৩৭৭ এ উল্লেখ রয়েছে।
একজন বিধবা মা তার সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পেতে হকদার। সন্তানেরা ভরণপোষণ না দিলে আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। (জমিলা খাতুন বনাম রুস্তম আলী, ৪৮ ডিএলআর (আপিল বিভাগ), পৃষ্ঠা ১১০।
দেনমোহরের দাবীতে কোন বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তি দখল করে থাকলে যদি তাকে অন্যায়ভাবে সেই সম্পত্তি হতে বেদখল করা হয়, তবে সে দখল পূণরুদ্ধারের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। (মজিদ মিয়া বনাম বিবি সাহেব (১৯১৬) ৪০ বম. পৃষ্ঠা-৩৪)।
যদি স্থাবর সম্পত্তি হয়, তাহলে বেদখলের তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হয়। (মশাল সিংহ বনাম আহমেদ হুসায়েন ১৯২৮, ৫০ অল. পৃষ্ঠা-৮৬, তামাদী আইন, ১৯০৮ তফসিল ১ অনুচ্ছেদ ৩)। তবে অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে বেদখলের বিষয় অবহিত হবার তারিখ থেকে তিন বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হয়। তামাদী আইন, ১৯০৮ তফসিল ১ অনুচ্ছেদ ৪৮)।
তবে দেনমোহরের জন্য বিধবা স্ত্রী স্বামীর ত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে থাকলে সেই সম্পত্তিতে প্রাপ্ত মুনাফা সম্পর্কে স্বামীর অন্যান্য ওয়ারেশদের হিসেব দেয়া বিধবার দায়িত্ব। (বিবি বাচান বনাম শেখ হামিদ (১৮৭১) ১৪ এম.আই.এ. পৃষ্ঠা ৩৭৭)।
দেনমোহর সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীদেরকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। (সূরা আল-আহ্যাব, আয়াত-৫০)।
স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থসম্পদ বিধবা স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। আইনে বিধবার ভরণ-পোষণের ব্যাপারে কারো ওপর বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সন্তানরা তাদের সাধ্যমতো ভরণ-পোষণ করার ব্যাপারে নীতিগতভাবে বাধ্য। সন্তান-সন্ততি না থাকলে আবার পিতামাতাকেও তাদের বিধবা মেয়ের ভরণ-পোষণ প্রদান করা নৈতিক দায়িত্ব। এছাড়া নারীর উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার কাছেও সম্পদ পায়, সেই হিসাবে বাবা না থাকলেও বিধবা তার বাবার মিরাসের উত্তরাধিকারী হবে।
আর তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মারা যায়, তারা তাদের স্ত্রীদের জন্য এই ‘অসিয়ৎ’ করবে যে, তাদেরকে যেন এক বছর পর্যন্ত ভরণপোষণ দেয়া হয় এবং গৃহ থেকে বের করে দেয়া না হয়। কিন্তু যদি তারা নিজে থেকে বেরিয়ে যায়, তবে নিয়মমত নিজেদের ব্যাপারে যে উত্তম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তাতে তোমাদের কোন পাপ নেই। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশালী বিজ্ঞতা সম্পন্ন। (আল-কোরআন- সূরা বাকারা ০২:২৪০)
এছাড়াও স্বামীর মৃত্যুর পর তারা কমপক্ষে এক বছর পর্যন্ত ভরণ পোষণ পাবার অধিকার রাখেন। স্ব-ইচ্ছায় অন্যত্র যেতে না চাইলে শ্বশুর বাড়ির লোকজন যেন তাদের বাড়ি থেকে জোর করে বের করে না দেন সেই নির্দেশও দেয়া হয়েছে। তবে ইদ্দত পালনের পর তারা যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে অন্য কোথাও যেতে চান (যেমন প্রাপ্য সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে সন্তান অথবা বাবার বাড়িতে থাকতে চান বা ব্যাবসা কিংবা চাকরি করে স্বাধীনভাবে জীবন কাটাতে চান) বা বিধিমত অন্য কাউকে বিয়ে করতে চান তবে তাতে কোন দোষ নেই। এক্ষেত্রে তাদের বাঁধা দেয়া যাবেনা।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী,আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮